পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলার পুরন্দ্রপুর গ্রামের বাসিন্দা উজ্জ্বল প্রামানিক। বয়সের (৭০ বছর) ভারে নুজ্ব্য একজন বৃদ্ধ। ৩ বছর আগে চোখে ছানি পড়ায় কিছুই দেখতে পেত না। আর্থিক অসঙ্গতির কারণে চিকিৎসাও করাতে পারে নাই। বৃদ্ধ বয়সে ছেলে-মেয়েরা দেখবে এমন ইচ্ছা সকল বাবা-মা'র থাকলেও উজ্জ্বল প্রামানিকের সেই স্বপ্ন পূরণ হয় নি। তার তিন ছেলের মধ্যে ২ ছেলেই বৃদ্ধ বাবা-মা’র কোনো খোজ নেয় না। একমাত্র ছোট ছেলের উপর ভরসা করেই এখনো বেঁচে আছে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। উজ্জ্বল প্রামাণিক লেখাপড়া শিখে নাই। তিনি মানুষের বাড়িতে গরু দেখাশোনা করে জীবন চালাতেন। বিভিন্ন সময় কাজের স্থান পরিবর্তনও করেছেন কিন্তু পেশার ধরন পরিবর্তন করতে পারেন নাই। গরু দেখাশোনা করে যা আয় হতো তাই দিয়েই ৩ সন্তানসহ ৫ জনের খরচ চালাতেন। পরিবারে একমাত্র তিনিই ছিলেন উপার্জনক্ষম। তার একার আয়েই তাদের সংসার চলতো। আয় অল্প হওয়ার কারণে সন্তানদের প্রয়োজনীয় কোনো কিছুই ঠিকমত দিতে পারতেন না উজ্জ্বল প্রামানিক। আর্থিক সংকটের কারণে তার তিন ছেলেই পড়ালেখায় মনযোগ দিতে পারে নাই। তারা অধিকাংশ সময়ই বাবার সাথে কাজে সহায়তা করতো। পড়াশোনার গুরুত্বও তারা ভালোভাবে বুঝতে পারে নাই। অভাবের কারণে জীবনে অর্থ উপার্জনই উজ্জ্বল প্রামানিকের ছেলেদের লক্ষ্য হয়েছিলো। মাত্র ৩ শতক জমিতে ২টি মাত্র ঘরে তাদের বসবাস। একটি ঘরে উজ্জ্বল প্রামানিক তার স্ত্রীসহ থাকেন। আরেকটি ঘরে তার ছোট ছেলে থাকে। উজ্জ্বল প্রামানিকের ৩ ভাই। তাদের মোট বসতি ভিটা ছিলো ১১ শতক। ৩ ভাগ হয়ে তার তিনি পান ৩.৬৭ শতক। এছাড়া তাদের আর কোনো সম্পত্তি বা কৃষিজমি ছিলো না। মানুষের বাড়ি গরু দেখাশোনা করে যে আয় হতো সেখান থেকে প্রায় ২০ বছর আগে একটি গরু কেনেন উজ্জ্বল প্রামানিক। সেই গরু তখন ছিলো তাদের আয়ের প্রধান উৎস। ইতোমধ্যেই তার বয়স হয়ে যাওয়াতে আগের মত কাজ করতে না পারার কারণে গরুর উপর ধীরে ধীরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। পর্যায়ক্রমে ধীরে ধীরে ৬টি গরুর মালিক হন উজ্জ্বল। এদিকে নিজেদের সংসার চালানোর জন্য বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণও নিয়েছিলেন। ছেলের বিয়ের খরচ, ঋণ পরিশোধ করা ইত্যাদি কারণে গরু বিক্রি করতে হয়েছে। বর্তমানে তাদের মাত্র ১টি গরু আছে। এরই মধ্যে তার বড় ছেলে জয়নাল প্রামানিকের জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসে। তবে মেয়েটি ছিলো বাক-প্রতিবন্ধী। ছেলে তখন মাত্র এসএসসি পরীক্ষা দেবে। এত অল্প বয়সে ছেলের বিয়ে দিতে চায় নি উজ্জ্বল প্রামানিক এবং তার স্ত্রী। সেই সময় মেয়ের বাড়ি থেকে বলা হয় জয়নালকে চাকুরির ব্যবস্থা করে দেবে। চাকুরির নেশা তখন পেয়ে বসে তার বড় ছেলে জয়নাল প্রামানিকের। দরিদ্র থাকার কারণে অতি দ্রুত ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকে জয়নাল। বিয়েতে রাজি না হওয়ায় "বাবা-মা তার ভালো চায় না" এই বলে বাবা-মা কে অভিযুক্তও করে। বাবা-মা’র অমতে এসএসসি পরীক্ষা না দিয়ে তখন বিয়ে করে জয়নাল। বিয়ের পর তার শ্বশুর বাড়ির সহায়তায় আনসারে চাকরি পায় সে। জয়নালের পোস্টিং ছিলো ঢাকা এয়ারপোর্টে। তবে তাকে ৬ মাস পরপর ৫০০০ টাকা দিয়ে চাকুরি নবায়ন করতে হয়। নবায়ন না করলে চাকরি থাকে না। একবার নবায়ন করে পরের বার আর নবায়ন করে নাই- ‘নবায়ন করে চাকুরি করতে পারবে না’। এদিকে তার অন্য কোনো চাকুরি করার শিক্ষাগত যোগ্যতাও তার ছিলো না। এমতাবস্থায় জয়নাল তার স্ত্রীকে রেখে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় এবং ৩/৪ বছর কোনো খোঁজ ছিলো না। এরপর তারা জানতে পারে জয়নাল প্রামানিক পাবনার আলতাপাড়ায় আরেকটি বিয়ে করে বসবাস করছে। সেখানে দিনমজুরি করে সে তার সংসার চালায়। তার প্রথম পক্ষের স্ত্রী তার বাবার বাড়ি এবং শ্বশুড় বাড়ি-দুই জায়গাতেই বসবাস করে। প্রথম পক্ষের স্ত্রী’র ঘরে দুইটি সন্তান। একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে। ৩ বছর আগে মেয়ের বিয়ে দেয়। এরই মধ্যে জয়নাল প্রামানিক বাড়িতে আসলে প্রথম পক্ষের ছেলের সাথে ঝগড়া হয়। তাদের প্রতি দায়িত্ব পালন না করার মানসিক যন্ত্রণা থেকে এই ঝগড়া বলে উজ্জ্বল প্রামানিক মনে করে। ঝগড়া করে জয়নাল প্রামানিকের ছেলে ঢাকায় চলে আসে। গ্রামে সে অটোরিক্সা চালাতো। বর্তমানে ঢাকাতে সবজি বিক্রি করছে। জয়নাল প্রামানিকের ২য় পক্ষের ঘরেও ১ ছেলে এবং ১ মেয়ে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে ২ বছর আগে মাত্র ১৬ বছর বয়সে। ছেলের বয়স ৫ বছর। তবে সে প্রতিবন্ধী। ছেলের দুই পা চিকন, হাঁটতে পারে না। ২য় পক্ষের স্ত্রীকে নিয়ে এখন আলতাপারায় বসবাস করছে জয়নাল। এভাবে বাবা-মা'র প্রতি কোনো দায়িত্বই পালন করে নাই বড় ছেলে জয়নাল প্রামানিক। উজ্জ্বল প্রামানিকের মেজ ছেলে জামাল প্রামানিকও তার স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা থাকে। উজ্জ্বল প্রামানিক বলেন- ‘আমি মরে গেলেও দু চোখে চেয়ে দেখে না সে’। মাত্র ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে জামাল। বর্তমানে দিনমজুরির কাজ করে সংসার চালায়। ১৯৯৮ সালে বিয়ের পর সে আলাদা হয়ে যায়। বড় ভাই জয়নাল ততদিনে বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। উজ্জ্বল প্রামানিকেরও বয়স হয়ে গিয়েছে। বাড়িতে তেমন আয় নেই। তখন আয়ের একমাত্র ভরসা জামাল। এমন সময় একদিন জামাল বললো যে সে আলাদা হবে। একা সে খরচ দিতে পারবে না। কিন্তু বাড়ির মধ্যে দেওয়াল তোলা পছন্দ হয় নি তার বাবার। তখন তার বাবা বলে, আলাদা হতে চাইলে বাড়ি থেকে চলে যেতে। এই কথা শুনে তার মেজ ছেলে জামাল বাড়ি থেকে চলে গিয়ে শ্বশুর বাড়ি আশ্রয় নেয়। সেখানে প্রায় ৩ বছর কাটানোর পর তাদের গ্রামের পাশে আদর্শ গ্রামে সরকারি জায়গা পায়। সেখানে প্রায় ৬ বছর থাকার পর সেই জায়গা বিক্রি করে দিয়ে আবার বাবার বাড়ি চলে আসে। ছেলের প্রতি মায়া ও ভালোবাসার কারণে তার ভাগের ১.৬৭ শতক জায়গা দিয়ে দেয়। সেখানে জামাল আলাদা ঘর তুলে বসবাস করছে। বাবা-মা’র প্রতি কোনো দায়িত্ব সে পালন করে নাই। বৃদ্ধ বাবা-মা কি করছে, ঠিকমত খাবার সংস্থান হচ্ছে কি-না কিংবা ঈদের সময় নতুন পোশাক কিনতে পারলো কি-না, অসুস্থতায় ভুগছে কি-না এসব বিষয়ে কোনো খেয়াল নেই তার মেজ ছেলের। স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে নিয়ে পুরোপুরি বাবা-মা থেকে পুরোপুরি আলাদা এবং বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করছে জামাল প্রামাণিক। উজ্জ্বল প্রামানিকের ছোট ছেলে কামাল প্রামানিক এখন তার একমাত্র ভরসা। তার স্বল্প আয়ে বাবা-মা কে নিয়ে বসবাস করছে। এসএসসি তে ইংরেজি এবং গণিতে ফেল করার পর আর পড়ালেখা করে নাই কামাল। এরপর দিনমজুরির কাজের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে। এটাই তার আয়ের একমাত্র উৎস। যতটুকু সামর্থ্য ততটুকু দিয়েই বৃদ্ধ বাবা-মা’র প্রতি দায়িত্ব পালন করছে সে। মাসে ১৫/১৬ দিন কাজ থাকে তার। প্রতিদিন কাজ করলে ৩০০ টাকা মজুরি পায়। এটা দিয়েই সংসার চলছে তাদের। তাদের খাবার তালিকাও উন্নত না। তার মা নদী এবং বিলের মধ্য থেকে শাক সংগ্রহ করে যা তাদের সবজির চাহিদা মেটায়। এছাড়া ডাল বা অন্যান্য ভর্তা দিয়ে ভাত খায়। মাছ-মাংস মাসে ৪/৫ দিন তাদের খাদ্য তালিকায় থাকে। কামাল প্রামানিকের ২ ছেলে। এক ছেলে ঈশ্বরদীতে কওমি মাদ্রাসায় হাফিজিয়া পড়ে। মাদ্রাসায় পড়ানোর কারণ হিসেবে সে বলে, টাকা নাই। মাদ্রাসায় পড়লে টাকা লাগবে না। তাই সেখানে দিয়েছি। আরেকটি ছেলের বয়স ৫ বছর। এরকম পরিস্থিতিতে প্রায় ৩ বছর আগে উজ্জ্বল প্রামানিকের চোখে ছানি পড়ে। কোনো কিছুই দেখতে পেত না সে। তাদের পরিবারের সেই আর্থিক সঙ্গতি নেই যে চিকিৎসা করবে। এমতাবস্থায় তার চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ করে প্রচেষ্টা। ২০১৭ সালের ৫ এবং ৬ আগস্ট উল্লাপাড়া চক্ষু ও জেনারেল হাসপাতালে তার চোখের অপারেশন করা হয়। কেন তার অপারেশনের ব্যয়ভার প্রচেষ্টা গ্রহণ করবে এই প্রশ্নে প্রচেষ্টা যে বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখে- (১) তার পরিবারের আর্থিক দূরাবস্থা, (২) বৃদ্ধ বয়সে পাশে সন্তানদের না থাকা, (৩) জীবনের বাকি দিনগুলো একটু ভালো কাটানো। বর্তমানে উজ্জ্বল প্রামানিক চোখে দেখতে পাচ্ছে। তার অপারেশনসহ অন্যান্য সকল ব্যয়ভার বহণ করে প্রচেষ্টা।