ঢাকা শহরের একজন বৃদ্ধ রিক্সাচালক গুলজার হোসেন। বয়স প্রায় ৭৫। তার বয়স আয়-রোজগার করার মত উপযুক্ত না হলেও ভাগ্যের খেলায় এখনও রিক্সা চালানোর মত পরিশ্রমের পেশা তাকে করতে হচ্ছে। ঢাকা শহরের মিরপুর ১৩ তে ছোট একটি ঘরে গুলজার এবং তার স্ত্রী বসবাস করছে। প্রতিদিন সকাল হলেই জীবনের তাগিদে গ্যারেজ থেকে রিক্সা নিয়ে বের হয়ে যান গুলজার। বয়সের ভারে ঠিকমত রিক্সা চালাতে পারেন না। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য তাকে এমন কঠিন পেশায় জরিত থাকতে হচ্ছে। গুলজার হোসেনের জন্ম কুড়িগ্রাম জেলার সদর উপজেলার কাঠালবাড়ি ইউনিয়নের প্রামানিকভারি গ্রামে। তার বাবা গ্রামে দিনমজুরির কাজ করতো। ৫ ভাই আর ৪ বোনের সংসার ছিলো তার বাবার। এত বড় পরিবারের খাবার সংস্থানের জন্য হিমশিম খেতে হতো তাকে। তার দিনমজুর বাবা কোনোরকমে আয় করে তাদের সংসার চালাতো। পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় গুলজারকে অল্প বয়সেই সংসারের হাল ধরতে হয়। পড়ালেখার প্রতি তেমন কোনো আগ্রহ ছিলো না তার। দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে আয়ের দিকেই মনোনিবেশ করেন গুলজার। ছোট বয়স থেকেই বাবার সাথে কাজে বের হয়ে যেতেন তিনি। ৬০র দশকে প্রতিদিন কাজ করে ১ টাকা থেকে ২ টাকা পেতেন যা এখনকার মূল্যে প্রায় ৫০০/৬০০ টাকা। তবে বয়সে ছোট থাকায় প্রতিদিন কাজ পেতেন না। অন্যদিকে তার বাবারও বয়স হয়ে যাওয়ায় প্রতিদিন কাজ থাকতো না। এভাবে কষ্ট করেই তাদের দিন চলতো। এরই মধ্যে ১৯৭০ সালে তিনি বিয়ে করেন। বিয়ের পর আয়ের সংস্থান করা আরও জরুরি হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তিনি চাল এবং আটার ব্যবসা শুরু করেন। পাইকারিভাবে চাল, আটা কিনে গ্রামের বাজারে খুচরা বিক্রি করতেন। পুঁজি কম থাকায় বড় আকারে ব্যবসা শুরু করতে পারেন নি। অন্যদিকে গ্রামের বাজারে পণ্যের চাহিদাও কম থাকে। এসব কারণে ব্যবসাও খুব বড় ছিলো না। সেইসময় প্রতিদিন ১ মণের বেশি চাল তিনি বিক্রি করতে পারতেন না। এগুলো বিক্রি করে দিন ২/৩ টাকা লাভ হতো তার। ২ বছর এই ব্যবসা করার পর গুলজার কাঠের ব্যবসা শুরু করেন। তিনি প্রথমে একটি গাছ কিনতেন। এরপর গাছের গুড়ি স মিলে বিক্রি করতেন এবং বাকি অংশ লাকড়ি আকারে বিক্রি করতেন। একটা গাছ কাটতে ২/৩ জন মজুর লাগতো যাদের দিন ১০ টাকা করে দিতে হতো। এছাড়া ভ্যান ভাড়া ১০০ টাকা লাগতো। বড় গাছ হলে একটা গাছ কাটতে ২/৩ দিন সময়ও লাগতো। এভাবে মাসে ১০০০ টাকা আয় করতেন। চালের ব্যবসার চেয়ে কাঠের ব্যবসায় লাভ বেশি থাকায় তিনি এটাতেই ঝুকে পড়েন। এভাবে ভালোই চলছিলো তার সংসার। কিন্তু বাঁধ সাজে অসুস্থতা। প্রায় ১০ বছর কাঠের ব্যবসা করার পর তিনি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। অনেক ভারি গুড়ি উঠানো-নামানোর সময় একবার তার কোমরে আঘাত লাগে। এটা থেকে তার কিডনীর সমস্যা হয়। তখন তিনি গ্রামের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা করিয়েছিলেন। এরপরেই তিনি আক্রান্ত হন টাইফয়েড এবং ডায়রিয়ায়। এভাবে বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার টাকা সব শেষ হয়ে যায়। এমনিতেই দরিদ্র হওয়ায় তার তেমন কোনো সঞ্চয় ছিলো না। এরই মধ্যে তার সন্তানদের জন্ম হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে তার যতটুকু সঞ্চয় ছিলো সব শেষ হয়ে যায়। আবার কোমরে আঘাত পাওয়ায় ভারি কাজ করার সামর্থ্যও হারিয়ে ফেলেন। বাধ্য হয়ে তিনি তখন রিক্সা চালানো শুরু করেন। রিক্সা চালাতে কোমোরের সমস্যা হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোমরে তো ব্যাথা লাগেই। কিন্তু কি করুম! গাছ কাটা বা ভ্যানে করে চাল বিক্রির চেয়ে এই কাজ একটু সহজ। আর গেরামেও তো কাম নাই! ওখানে থাকলে কি আর দিন চলে! অসুস্থ হয়ে যাওয়ায়, এবং সংসার চালানোর তাড়নায় তিনি ১৯৮৮ সালে দিনাজপুরে এসে রিক্সা চালানো শুরু করেন। সেখানে তিনি, তার স্ত্রী এবং ২ ছেলে এবং তিন মেয়ে নিয়ে একটি মাত্র ঘরে বসবাস করতেন। সেই সময় ২০০ টাকা ঘরভাড়া দিয়ে তারা সেখানে থাকতেন। সংসারে বাড়তি আয়ের জন্য তার স্ত্রী মানুষের বাড়িতে কাজ করতেন। সেইসময় মাসে ২০০ টাকা পেতেন। সেখানে ২ বছর থাকার পর তিনি ঢাকায় আসেন। ঢাকায় রিক্সা চালিয়ে আয় বেশি হওয়ায় মূলত তিনি ঢাকার পথে পা বাড়ান। এছাড়া কুড়িগ্রামের অধিকাংশ লোক ঢাকায় এসে রিক্সা চালাচ্ছে। এটা দেখে তিনিও ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে প্রথমে তিনি কাজীপাড়া থাকতেন। ২ বছর ঢাকায় থাকার পর তিনি আবার গ্রামে ফিরে যান। সেখানে তিনি পুনরায় কাঠের কাজ শুরু করেন তবে ভিন্ন উপায়ে। তখন তিনি লোক দিয়ে বিভিন্ন আসবাবপত্র যেমন: চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি তৈরি করতেন। কিন্তু সেখানেও তার তেমন আয় হতো না। প্রথমত, তার পুজি না থাকায় ভালো কাঠ কিনতে পারতেন না। ২০০/৩০০ টাকায় নিম গাছ কিনে আসবাবপত্র বানাতেন। দ্বিতীয়ত, নিম কাঠের আসবাবপত্রের বাজার মূল্য কম হলেও মিস্ত্রির মজুরি একই লাগতো। তাই লাভের পরিমাণ ছিলো খুবই সামান্য। তাই আবার তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে প্রথমে মোহাম্মদপুর এবং কিছুদিন পর মিরপুর-১৩ নম্বরে নতুন বাজারের কাছে ৯ নং রোডে বসবাস শুরু করেন। এখন তার বয়স প্রায় ৭৫ হলেও জীবিকার তাগিদে তাকে রিক্সা চালাতে হচ্ছে। তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছোট একটি ঘরে তারা বসবাস করে। ঘরে আসবাব বলতে কিছুই নেই। শোবার জন্য শুধু একটি খাট আর একটি আলনা আছে। এই বাসার জন্য প্রতি মাসে তাদের ৩০০০ টাকা দিতে হয়। শুধু তিনি নন, তার আশেপাশের অনেক রিক্সাচালক এভাবে একটি মাত্র কক্ষ ৩/৪ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে থাকে। রিক্সা চালানো সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, এই বয়সে তো রিক্সা চালানো যায় না। কিন্তু কি করবো? বেঁচে তো থাকতে হবে।” প্যাসেঞ্জারও খুব বেশি পান না বলেই তিনি জানান। বেশি বয়স হওয়ায়, লোকজন সাধারণত তার রিক্সা বাদ দিয়ে কমবয়সী চালকের রিক্সায় উঠতে চায়। এরজন্য দুইটি কারণ তিনি বলেন। প্রথমত, তিনি দ্রুত চালাতে পারেন না এবং দ্বিতীয়ত, অনেকে তার রিক্সায় চড়ে কষ্ট পায়, বয়স বেশি বলে। অনেকে আবার ৫/১০ টাকা বাড়িয়ে দেন। এসব কারণে তিনি প্যাসেঞ্জার কম পান। আবার অন্যদিকে, তার পক্ষে একটানা রিক্সা চালানো সম্ভব হয় না। একটা ভাড়া টানার পর একটু বিশ্রাম না নিয়ে বা কিছু না খেলে চালাতে পারেন না। যেখানে কমবয়সীরা প্রতিদিন ৮০০/৯০০ টাকা আয় করে সেখানে তিনি প্রতিদিন ৪০০/৫০০ টাকা আয় করে থাকেন। এরমধ্যে ১০০ টাকা ভাড়া দিলে তার নীট আয় হয় ৩০০/৪০০ টাকা। আবার প্রতিদিন তিনি রিক্সা নিয়ে বের হতে পারেন না। রিক্সা চালকদের কোনো কর্মঘন্টা নেই। প্রতিদিন রিক্সা নিয়ে বের হলে ১০০ টাকা ভাড়া দিতে হয়। কেউ সকাল ৬টায় রিক্সা নিয়ে বের হয়ে রাত ৩/৪টা তেও জমা দিতে পারে। অনেক সময় তিনি রাতেও রিক্সা চালান। রাতে চালালে ভাড়া বেশি পাওয়া যায় বলে অনেকেই এমনটা করে। তবে রাতে চালালে পরের দিন সকালে রিক্সা চালাতে পারেন না। তিনি আরও জানান যে, ঢাকা শহরে একজন রিক্সা চালক গড়ে ১০ ঘন্টার উপরে রিক্সা চালায়। যেখানে অন্যান্য খাতে শ্রমিকরা ৮/৯ ঘন্টা কাজ করে সেখানে তাদের খাটতে হয় ১০ ঘন্টার বেশি। তবে তিনি তার নিজের উদাহরণ দিয়ে বলেন, সকালে রিক্সা নিয়ে বের হই। যখন কিছু টাকা হাতে আসে তখন বাজার করে একটু বিশ্রাম নেই। আরেকবার খ্যাপ দিয়ে দুপুরে খেয়ে আবার বের হই। এভাবে আর কত টাকাই বা আয় হয়? এমনকি গরম অথবা বর্ষার মধ্যেও কষ্ট করতে হয়। এটা না করলে না খেয়ে তাদের থাকতে হবে। তার সাথে কথা বলে জানা যায়, এখন গ্রাম থেকে প্রচুর লোক রিক্সা চালানোর উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসছে। গ্রামে তেমন কাজ নেই বা থাকলেও সারা বছর খাবার সংস্থান করার মত কোনো কাজ নেই যা করে তারা সংসার খরচ নির্বাহ করতে পারবে। এছাড়া জেলা শহরগুলোতে অটোরিক্সা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রিক্সা ভাড়াও বেড়েছে। ফলে সাধারণ লোক এখন আর রিক্সা চড়ে না। তখন বাধ্য হয়েই তাদের ঢাকায় স্থানান্তরিত হতে হচ্ছে। তাদের জীবন ধারণ এবং নির্বাহের জন্য তিনি খুবই মানবেতর জীবন ধারণ করে চলেছেন। তিনি বলেন, আমরা তো মানুষ টেনে বেড়াই। কিন্তু তার জন্য যে খাওয়া-দাওয়া দরকার তা আমরা পাই না। ডাল-ভাত খেয়েই আমাদের জীবন চলে। তার খাবার তালিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, সপ্তাহের ৫ দিন ডাল, সবজি দিয়েই খেতে হয়। ২/১ দিন বাজার থেকে ছোট মাছ কিনে আনেন। মাংস খেতে পান না বললেই চলে। এবার ঈদেও কোরবানি তো দূরের কথা তারা কোনো মাংসও কিনতে পারেন নাই। মাঝে মাঝে তারা মুরগী কিনে আনেন কিন্তু সেটা মাসে ১/২ বার। এমনকি নতুন পোষাকও তিনি এবং তার পরিবার কিনতে পারেন নাই। শুধু ঈদে না, বছরের অন্যান্য সময়েও তেমন ভালো পোশাক কিনতে পারেন না। তার স্বপ্ন ছিলো ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করবেন। কিন্তু সংসারের অভাব আর ছেলে-মেয়েদের অনাগ্রহে তার সেই ইচ্ছা পূরণ হয় নি। আর ছেলেরা ছিলো তার সম্বল। তার বড় ছেলে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত এবং ছোট ছেলে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। তার বড় ছেলে বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে ৭/৮ বছর আগে। সে কাজীপাড়া থাকে এবং সিএনজি চালায়। তার আয়-রোজগার ভালো হলেও বাবা-মা'র প্রতি কোনো দায়-দায়িত্ব পালন করে না। এটা তার দুঃখের প্রধান কারণ। তার ছোট ছেলে ঢাকায় গার্মেন্টে কাজ করতো। কিন্তু সেখানে বেতন ঠিকমত দিতো না। তখন সে চাকুরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে যায়। গ্রামে সে দিনমজুরির কাজ করে। গুলজার হোসেনের দুই মেয়ের বিয়ে হলেও তার এক মেয়ে ৯ম শ্রেণিতে পড়ে। সে এবং তার ভাই নানাবাড়িতে থাকে। তার নিজস্ব যে বসতি জমি ছিলো চিকিৎসা এবং অভাবের কারণে বিক্রি করে দিতে হয়েছে। একমাত্র ছোট ছেলেই তাদের সাথে যোগাযোগ রাখে। তবে আয় কম হওয়ায় বাবা-মাকে তেমন সাহায্য করতে পারে না। এছাড়া ছোট বোনের পড়াশোনার খরচও চালাতে হয়। অন্যদিতে গুলজার হোসেনের নিজস্ব কোনো সম্পদ নেই। তার গ্রামে যে জমিটুকু পৈতৃকসূত্রে পেয়েছিলেন সেটাও অসুস্থতার কারণে বিক্রি করে দিতে হয়েছে। জমি বিক্রি করার কারণ হিসেবে তিনি জানান, তার বাবার ৩ বিঘা জমি ছিলো এবং তারা ছিলো ৫ ভাই এবং ৪ বোন। বোনদের বিয়ের সময় জমি বিক্রি করতে হয়েছে। বোনদের বিয়ে দিয়ে যা অবশিষ্ঠ ছিলো সেখানে ভাগাভাগি হয়ে তিনি ১৫ শতক পেয়েছিলেন। একেবারে সহায়-সম্বলহীন ভাবে তিনি রিক্সা চালানো শুরু করেন। এখন শেষ বয়সে এসে রিক্সাই তার ভরসা। বর্তমানে একজন বৃদ্ধ হিসেবে তাকে বিভিন্ন সমস্যার মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করতে হয়। জীবনে চলার পথে তার প্রধান সমস্যাগুলো হলো: (১) শারীরিক সমস্যা: গুলজার মিয়ার বয়স বর্তমানে প্রায় ৭৩। বর্তমানে তিনি বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। এই বয়সে যে কোনো ব্যক্তিই বার্ধক্যজনিত রোগে ভোগেন। ব্যতিক্রম নন তিনিও। সমগ্র শরীরে ব্যাথাসহ কিডনীর সমস্যা রয়েছে তার। যখন তিনি কাঠের ব্যবসা করতেন তখন কোমরে আঘাত পাওয়ায় কিডনীর সমস্যা হয়েছিলো। ওষুধ খেয়ে ভালো হলেও পরে আর ডাক্তার দেখান নি। কিন্তু নিয়মিত চেক-আপের প্রয়োজন আছে যা অর্থের অভাবে সম্ভব হয় নি। এছাড়া একসময় তার টাইফয়েডও হয়েছিলো। এগুলো মিলিয়ে তার নিয়মিত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ রাখা প্রয়োজন হলেও সেটা সম্ভব হয় না। এবং নিয়মিত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ না রাখার কারণে তিনি আরও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন বলে তিনি মনে করেন। কিন্তু ডাক্তার দেখানোর মত আর্থিক সামর্থ তার নেই। (২) অর্থনৈতিক সমস্যা: দরিদ্র বয়স্কদের অন্যতম একটি সমস্যা হলো তাদের অর্থনৈতিক দূরাবস্থা। গুলজার হোসেনও একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই যাচ্ছেন। মাস শেষে বাড়ি ভাড়া যোগাড় করাই তার পক্ষে কষ্টকর হয়ে যায়। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এই বয়সে তো আর কাজ করতে পারি না। বৃদ্ধ বয়সে সন্তানরা যদি না দেখে তাহলে আর কষ্টের সীমা থাকে না। তার স্ত্রী মোছা: ফাতেমা বলেন, বিয়ের পর ছেলেদের মন অন্যরকম হয়ে যায়। এখনো তুমি বিয়ে করি নাই, বিয়ে করো তারপর বুঝবা”। এছাড়া তিনি রিক্সাও ঠিকমত চালাতে পারেন না। এছাড়া তাদের আয় অল্প থাকায় কোনো সঞ্চয়ও তাদের নেই। গুলজার আহমেদ মনে করেন, যদি অল্প বয়সে কষ্ট করে একটু একটু করেও টাকা জমাতেন তাহলে এখন তাই দিয়ে চলতে পারতেন। (৩) একাকীত্ব: বৃদ্ধ বয়সে গুলজার হোসেন একাকীত্বের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। তিনি বলেন, “এই বয়সে সবাই চায় সন্তানদের সাথে থাকতে। কিন্তু আমাগো ভাগ্যে আর তা নাই। এখনো কষ্ট করে রিক্সা টেনে পেট চালাইতে হয়। এই বয়সে কি আর এগুলা ভাল লাগে! অর্থাৎ তিনি তার সন্তানদের সাথে থাকতে চান কিন্তু আর্থিক সমস্যার কারণে এটা সম্ভব হচ্ছে না। (৪) অধিক পরিশ্রম: তিনি বলেন, এখন তো আমার পরিশ্রম করার বয়স না, তারপরেও পরিশ্রম করতে হয়। একটানা বেশিক্ষণ রিক্সা চালাতে পারি না। অন্যান্যদের চেয়ে আমার রোজগারও কম। বয়স হয়ে গেছে বলে আমার রিক্সায় উঠতে চায় না। জোরেও রিক্সা টানতে পারি না। সারাদিন রিক্সা চালিয়ে আয় খুবই কম হয়। তাই বাধ্য হয়ে অনেক রাত পর্যন্তও রিক্সা চালাতে হয়” অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, বয়সের তুলনায় অধিক পরিশ্রম করতে হচ্ছে গুলজার হোসেনকে শুধু দুবেলা ভাতের সংস্থান করার জন্য। তিনি মূলত ঢাকা শহরের মিরপুরের ১৩ থেকে শুরু করে ১০ নম্বর এবং কচুক্ষেত পর্যন্ত রিক্সা চালান। এর বাইরে তিনি রিক্সা নিয়ে যান না। কারণ হিসেবে তিনি জানান, এই দিকের রাস্তায় জ্যাম কম। ঢাকা শহরের অন্যান্য রাস্তায় প্রচুর জ্যাম। গরম এবং জ্যামের মধ্যে রিক্সা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হয়। আয় কম হলেও, একটু আরামের জন্য তিনি এই দিকেই রিক্সা চালান। এছাড়াও এই রুটে অনেক রাস্তা আছে যেখানে রিক্সা চালাতে কষ্ট হয়। কিন্তু তারপরেও জীবনের তাগিদে ওই রাস্তা দিয়েও রিক্সা চালাতে হয়। তিনি বলেন, এরকম রাস্তায় জোয়ানরাও রিক্সা চালাতে পারে না। কিন্তু কি করুম! অন্য রাস্তাতেও তো তেমন যাই না। বেঁচে থাকতে হলে তো এসব রাস্তা দিয়ে রিক্সা চালাতেই হবে। (৫) চিকিৎসা সংকট: গুলজার হোসেন তার পরিবারসহ ভয়াভহ চিকিৎসা সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। তার তো বয়স হয়েছেই, পাশাপাশি তার স্ত্রী'র ও বয়স হয়ে গিয়েছে। বার্ধক্যজনিত কারণে দুজনেরই নিয়মিত ডাক্তারের কাছে যাওয়া প্রয়োজন হলেও অর্থের অভাবে যে কোনো ধরনের চিকিৎসা সেবা থেকে তারা বঞ্চিত। সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে বা ১০ টাকার টিকিট কেটে ডাক্তার দেখানো গেলেও, বিভিন্ন পরীক্ষা, ওষুধ ইত্যাদির জন্য যে অর্থ দরকার সেটা তারা সংস্থান করতে পারবেন না। এই কারণে কোনো ডাক্তারের কাছে তারা যেতে পারেন না। গুলজার হোসেন বলেন, এভাবেই হয়তো ধুকে ধুকে মরতে হবে আমাদের। ডাক্তার, চিকিৎসা এগুলো তো বড়লোকদের জন্য, আমাগো জন্য না। (৬) কাজ করায় অক্ষমতা: বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ায় গুলজার হোসেনের কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছেন এবং যত দিন যাবে তার কাজ করার সামর্থ কমতে থাকবে। এমতাবস্থায় কত দিন তিনি আর রিক্সা চালাতে পারবেন জানেন না। আগামি ৩/৪ বছর পর তার কাজ করার সামর্থ্য একেবারেই হারিয়ে যাবে বলে তিনি মনে করছেন। কষ্ট করে রিক্সা চালাতেও তিনি আর পারছেন না। এমতাবস্থায় আগামি দিনে তিনি কিভাবে জীবন নির্বাহ করতে চান এটা জানতে চাইলে তিনি জানান, যেহেতু তার কাজ করতেই হবে তাই বসে থেকে করা যায় এমন কাজ হলে তার সুবিধা হয়। তিনি এখন মূলত কোনো এপার্টমেন্টের সিকিউরিটি অফিসার ধরনের কাজ করতে চান। এই কাজ তিনি বসে থেকে করতে পারবেন বলে এটাতেই তার আগ্রহ। এছাড়া এই কাজ তার শরীরের উপর তেমন প্রভাব ফেলবে না বলেও তিনি মনে করেন। (৮) আবাসন সংকট: গুলজার হোসেন জানান, তিনি যে অবস্থায় থাকেন সেইটা একজন বৃদ্ধের জন্য মানবেতন জীবন-যাপন। তার সাথে কথা বলে জানা যায়, ঢাকা শহরের অন্যান্য রিক্সা চালকের আবাসন ব্যবস্থাও একই রকম। ঢাকা শহরে বাসা মালিকরা তাদের মত নি¤œ আয়ের মানুষদের জন্য সারি করে অনেকগুলো ঘর করেন। সেখানে প্রতিটি কক্ষ তারা ভাড়া দেন। সাধারণত একজন রিক্সাচালক একটি ঘরই ভাড়া নেন। প্রতিটি কক্ষের ভাড়া ২৫০০-৩০০০ টাকা। তিনি যে ঘরে থাকেন সেটার ভাড়া প্রতি মাসে ৩০০০ টাকা। তাই একের অধিক ঘর ভাড়া নেওয়া অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। কিন্তু সেই ঘরগুলোর অবস্থা অনেক নাজুক। ইটের দেওয়াল থাকলেও উপরে টিনের চাল। গরমের সময় দিনের বেলা খুবই কষ্ট হয় যা এই বয়সে সহ্য করা কঠিন। এছাড়া টিনের চাল হওয়ায় বড় কোনো ঝড় হলে টিনের ক্ষতি হয় বা অনেক সময় টিন ফুটো হয়ে যেয়ে বৃষ্টির সময় পানি পড়ে। মালিক এগুলো সারতেও সময় নেয়। এই কষ্ট অল্প বয়সীরা যত সহজে সহ্য করতে পরলেও তার পক্ষে সম্ভব না বলে তিনি জানান। (৯) খারাপ ব্যবহার: গুলজার হোসেন জানান, রিক্সা রাখাকে কেন্দ্র করে প্রায়ই বিভিন্ন ব্যক্তি বিশেষ করে কোনো দোকানের সামনে রিক্সা রাখলে বা সরু গলিতে গাড়ি ঢুকলে প্রায়ই খারাপ ব্যবহার সহ্য করতে হয়। তিনি বলেন, যারা আমাদের সাথে এরকম ব্যবহার করে তারা আমার ছেলের বয়সী। তারা যখন ওগুলো বলে, তখন আমি সহ্য করতে পারি না। শহরে তো রিক্সা রাখার মত জায়গা নেই। একটা ভাড়া নামিয়ে দিয়ে রেস্ট নেওয়ার জন্য হলেও বা কিছু খাওয়ার জন্যেও রিক্সা একটা জায়গায় রাখা লাগে। হয়তো দেখা যায় যেখানে রিক্সা রাখি তার সামনে বা কিছু দূরে একটা দোকান আছে কিংবা কোনো গাড়ি আসছে। তখন তারা খুবই খারাপ ব্যবহার করে। আবার অনেক সময় যাত্রীরাও খুব খারাপ ব্যবহার করে ৫/১০ টাকা ভাড়ার জন্য। এটা এই বয়সের মানুষের পক্ষে সহ্য করা কঠিন। অর্থাৎ রিক্সা নিয়ে রাস্তায় বের হলে নানাবিধ কারণে বিভিন্ন মানুষের খারাপ কথা শুনতে হয় তা একজন বয়স্ক মানুষ হিসেবে সহ্য করতে পারেন না। (১০) বিভিন্ন উৎসবে সাধ পূরণে অক্ষমতা: গুলজার হোসেন এবং তার স্ত্রী বিভিন্ন উৎসব বিশেষ করে বছরের দুই ঈদে কোনো সাধই পূরণ করতে পারেন না। তিনি বলেন, সারা বছর ঠিকমত খাইতে পাই না। কিন্তু ঈদের মধ্যে তো ইচ্ছা করে একটু ভালো-মন্দ খাই, নতুন জামা গায়ে দিই। কিন্তু এক ছেলে তো আমাকে দেখেই না। অন্য ছেলেরই ইনকাম নেই। এমন অবস্থায় ঈদের দিন আমাদের কাছে সাধারণ দিনের মতই।” তিনি আরও জানান, গত রমজানের ঈদে নতুন কোনো জামা কিনতে পারে নাই, স্ত্রীকেও কিছু কিনে দিতে পারে নাই। এমনকি এই বছর কোরবানি ঈদে কোরবানি তো দূরের কথা, মাংসও কিনে খেতে পারে নাই। তাদের বাড়িওয়ালা কোরবানির কিছু মাংস দেওয়ায় ঈদের মধ্যে মাংসের স্বাদ পেয়েছিলো। জীবিকার তাগিদে ঈদের মধ্যেও রিক্সা নিয়ে বের হয়ে পড়েন গুলজার। তিনি জানান, ঈদের দিন থেকে শুরু করে ২/৩ দিন পর্যন্ত ভাড়া বেশি পাওয়া যায়। তাই অনিচ্ছা থাকলেও, অন্যের আনন্দে নিজের কষ্ট হলেও একটু বেশি আয়ের আশায়, একটু ভালো থাকার আশায় উৎসবের দিনেও রিক্সা চালান। এভাবেই ঈদের মধ্যে অন্যের আনন্দ দেখে নিজেই ডুকরে কেঁদে উঠে গুলজার হোসেন। (১১) পুষ্টির অভাব: গুলজার হোসেন এবং তার স্ত্রী'র দিকে তাকালেই বোঝা যায় তারা পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। যত না তার বয়স তার চাইতেও বয়স্ক দেখায় গুলজার এবং স্ত্রীকে। তাদের খাদ্য তালিকায় সুষম খাবার তো দূরের কথা, সামান্য পুষ্টিকর খাবারও থাকে না। সপ্তাহে ৫ দিন তারা বিভিন্ন সবজি দিয়েই ভাত খায়। ২/১ দিন গুলজার বাজারে গিয়ে অল্প দামের মাছ কিনে আনেন। ভালো মাছ খাওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই। তিনি আরও জানান, বর্তমান বাজারে জিনিসপত্রের উচ্চমূল্যের কারণে সবজি-ভাত খাওয়াই কষ্টকর সেখানে ভালো মাছ বা মাংস দিয়ে ভাত খাওয়ার কথা তারা চিন্তাও করতে পারে না। এভাবে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন গুলজার এবং তার স্ত্রী। বৃদ্ধ বয়সে পুষ্টির চাহিদা বেড়ে যায়। তার উপরে রিক্সা চালানোর মত কঠিন পরিশ্রম করায় তার পুষ্টির চাহিদা আরও বেশি। কিন্তু আর্থিক অনটনের কারণে নিজের এবং পরিবারের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে পারেন না গুলজার হোসেন। (১২) উদ্যোগী হয়ে কোনো কাজ করার সামর্থ্যরে অভাব: বর্তমানে রিক্সা চালানো বাদ দিয়ে অন্য কোনো কাজ যেমন রাস্তার ধারে ছোট দোকান দেওয়া ইত্যাদি কাজও যদি তিনি করতে যান সেটা তার পক্ষে করা প্রায় অসম্ভব। ক্ষুদ্র আকারে কোনো ব্যবসা করতে হলেও পুঁজির প্রয়োজন যেটা তার নেই। ব্যাংক থেকে লোন নিতে পারবেন না কারণ লোনের বিপরীতে রাখার মত সম্পদ নেই। আর ক্ষুদ্র ঋণ নিয়েও ব্যবসা শুরু করা তার পক্ষে অসম্ভব। কারণ হিসেবে তিনি জানান, ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করলে, ব্যাবসার লাভ হতে না হতেই আবার কিস্তি দিতে হবে। তখন লাভ করা সম্ভব হবে না বলে তিনি মনে করেন। এছাড়া যদি শোধ দিতে না পারেন বা কিস্তি দিতে দেরি হয় তাহলে বাড়ির উপর অফিস থেকে লোক এসে অপমান করে আবার ক্ষেত্র বিশেষে ঘরের জিনিসপত্রও নিয়ে চলে যায়। যদি তার ছেলেরা সাথে থাকতো তাহলে হয়তো তিনি ক্ষুদ ঋণ নেওয়ার সাহস করতেন বলে জানান। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রচেষ্টার নজরে আসে গুলজার হোসেন। তার সার্বিক পরিস্থিত ভালোভাবে জানার জন্য একদিকে যেমন তার সাথে কথা বলা হয় অন্যদিকে তার প্রতিবেশি ও তার আশেপাশের অন্যান্য রিক্সাচালকদের সাথেও কথা বলা হয়। এরপর চূড়ান্তভাবে তাকে প্রচেষ্টায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তার সাথে কথা বলে ঠিক করা হয় এমন কোনো ব্যবসা শুরু করতে হবে যা গুলজার এবং তার স্ত্রী দুজনে মিলে করতে পারে। প্রাথমিকভাবে তাকে দিয়ে শাড়ী, লুঙ্গীর ব্যবসা শুরু করানো হয়। ধীরে ধীরে তিনি এই ব্যবসায় লাভ করতে থাকেন। বর্তমানে তিনি ও তার স্ত্রী দুজনে মিলে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। গুলজার রাস্তার পাশে বসে শাড়ী, লুঙ্গী বিক্রি করে এবং তার স্ত্রী বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করে। এই ব্যবসা থেকে প্রাপ্ত লাভ রিক্সা চালানো থেকে অনেক বেশি। ব্যবসা করে যা আয় হয় তাই দিয়ে ঘর ভাড়া পরিশোধ করে ভালোভাবে তার দিন কাটছে। একদিকে তার পরিশ্রম যেমন কমে গেছে অন্যদিকে তার খাবারের তালিকায় পুষ্টিকর খাবার যুক্ত হয়েছে, চিকিৎসা সংকটের সমাধান হয়েছে।